প্রথম উৎস: আল-কুরআনুল কারীম:
ইসলামী শরী‘য়াহ এর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে আল-কুরআনুল কারীম। এটি قرأ ক্রিয়ার মাসদার। এর শাব্দিক অর্থ: জমা করা, একত্র করা। অতঃএব, القراءة অর্থ: উচ্চারণে এক হরফকে আরেক হরফের সাথে মিলানো। আল-কুরআনকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ কিতাব নামে খাস করা হয়েছে। ফলে কুরআনকে কিতাব বলা হয়। কতিপয় উলামা বলেছেন, আল্লাহর কিতাবসমূহের মধ্যে এ কিতাবকে কুরআন বলার কারণ হলো এটা অন্যান্য সব কিতাবের সারাংশ, বরং সব ইলমের সারমর্ম এতে একত্রিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে বলেছেন:
﴿ لَقَدۡ كَانَ فِي قَصَصِهِمۡ عِبۡرَةٞ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِۗ مَا كَانَ حَدِيثٗا يُفۡتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصۡدِيقَ ٱلَّذِي بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ١١١ ﴾ [يوسف: ١١١]
“তাদের এ কাহিনীগুলোতে অবশ্যই বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষা, এটা কোনো বানানো গল্প নয়, বরং তাদের পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ। আর হিদায়াত ও রহমত ঐ কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।” [সূরা ইউসুফ: ১১১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
﴿ وَيَوۡمَ نَبۡعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٖ شَهِيدًا عَلَيۡهِم مِّنۡ أَنفُسِهِمۡۖ وَجِئۡنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِۚ وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]
“আর স্মরণ কর, যেদিন আমি প্রত্যেক উম্মতের কাছে, তাদের থেকেই তাদের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী উত্থিত করব এবং তোমাকে তাদের উপর সাক্ষীরূপে হাযির করব। আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সংবাদস্বরূপ”। [সূরা আন-নাহল: ৮৯]
উলামাগণ আল-কুরআনের সংজ্ঞায় বলেছেন:
القرآن هو كلام الله الذي أنزل على محمد r، ونقل إلينا تواترًا لنتعبد بتلاوته وأحكامه، وليكون آية دالة على صدق رسول الله r في رسالته، وقد نزل به جبريل على رسول الله r بلسان عربي.
আল- কুরআন হলো আল্লাহর কালাম যা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে এবং আমাদের কাছে মুতাওয়াতির তথা অসংখ্য ধারাবাহিক বর্ণনার মাধ্যমে পৌঁছেছে, যাতে আমরা এর তিলাওয়াত ও আহকাম পরিপালনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করি, আর যাতে এটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের সত্যতার দলিল হয়ে যায়। জিবরীল আলাইহিস সালাম এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরবি ভাষায় নাযিল করেছেন। [1]
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَإِنَّهُۥ لَتَنزِيلُ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٩٢ نَزَلَ بِهِ ٱلرُّوحُ ٱلۡأَمِينُ ١٩٣ عَلَىٰ قَلۡبِكَ لِتَكُونَ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ١٩٤ بِلِسَانٍ عَرَبِيّٖ مُّبِينٖ ١٩٥ ﴾ [الشعراء: ١٩٢، ١٩٥]
“আর নিশ্চয় এ কুরআন সৃষ্টিকুলের রবেরই নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত আত্মা এটা নিয়ে অবতরণ করেছে। তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।” [সূরা আশ-শু‘আরা: ১৯২-১৯৫]
ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের লোকদেরকে কুরআনের অনুরূপ কিছু নিয়ে আসতে চ্যালেঞ্জ করলেন। তখনকার সময়ে তারা সাহিত্যের বাগ্মিতা ও বয়ানে ছিল সেরা। কিন্তু তারা অক্ষম হলো। এভাবেই কুরআন তাদের বিপক্ষে দলিল হিসেবে দাঁড়ালো।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣ ﴾ [البقرة: ٢٣]
“আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও”। [সূরা আল-বাকারা: ২৩]
আল-কুরআন হলো দ্বীনের মূলভিত্তি, ইসলামি শরী‘য়াহর মূল উৎস, সর্বযুগে ও সর্বদেশে এটি আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল।
সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে তিলাওয়াত, হিফয, অর্থ পড়া ও এ অনুযায়ী আমল করা ইত্যাদি সরাসরি গ্রহণ করেছেন।
قال أبو عبد الرحمن السّلمي: حدثنا الذين كانوا يقرِّؤننا القرآن: عثمان بن عفان، وعبد الله بن مسعود، وغيرهما، أنهم كانوا إذا تعلموا من النبي r آيات لا يتجاوزونها حتى يتعلموها وما فيها من العلم والعمل، قال: «فتعلمنا القرآن والعلم والعمل جميعًا».
“আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামী (রহ.) বলেছেন, আমাদের কাছে সে সব সাহাবাগণ বর্ণনা করেছেন যারা আমাদেরকে কুরআন শিখিয়েছেন, যেমন উসমান ইবন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ প্রভৃতি। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দশটি আয়াত শিখলে যতক্ষণ না এর সব ইলম ও আমল শেষ না হতো ততক্ষণ সামনে এগুতেন না। তারা বলেছেন: এভাবে আমরা ইলম ও আমল উভয় সহকারে কুরআন শিখেছি।”[2]
যুগে যুগে মুসলমানগণ কুরআন হিফয করে আসছে। মুসলিম উম্মাহ কালের পরিক্রমায় বংশানুক্রমে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ছাড়াই কুরআন লিখিতভাবে বর্ণনা করে আসছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীরই প্রতিফলন:
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
“আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক”। [সূরা হিজর, আয়াত ৯]
দ্বিতীয়ত: সুন্নাহ ও শরীয়াহ আইনে এর অবস্থান:
সুন্নাহ এর শাব্দিক অর্থ পথ, পদ্ধতি ও জীবন চরিত; চাই তা প্রশংসনীয় হোক বা নিন্দনীয়। এ শব্দটির ব্যবহার আল-কুরআনে ও হাদীসে এ অর্থে এসেছে। যেমন: আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ سُنَّةَ مَن قَدۡ أَرۡسَلۡنَا قَبۡلَكَ مِن رُّسُلِنَاۖ وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحۡوِيلًا ٧٧ ﴾ [الاسراء: ٧٧]
“তাদের নিয়ম অনুসারে যাদেরকে আমি আমার রাসূলদের মধ্যে তোমার পূর্বে পাঠিয়েছিলাম এবং তুমি আমার নিয়মে কোনো পরিবর্তন পাবে না”। [সূরা আল-ইসরা: ৭৭]
﴿ سُنَّةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلُۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ ٱللَّهِ تَبۡدِيلٗا ٢٣ ﴾ [الفتح: ٢٣]
“তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর তুমি আল্লাহর নিয়মে কোনো পরিবর্তন পাবে না”। [সূরা আল-ফাতহ: ২৩]
হাদীসে এ শব্দটির ব্যবহার এভাবে এসেছে:
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ»، قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ: اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى قَالَ: «فَمَنْ»
“আবু সাঈদ খুদুরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের আচার-আচরণকে পুরোপুরি অনুকরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে, প্রতি হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি গুঁইসাপের গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও এতে তাদের অনুকরণ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি ইহুদি ও নাসারা? তিনি বললেন: আর কারা?” [3]
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً، فَلَهُ أَجْرُهَا، وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً، كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো উত্তম প্রথা বা কাজের প্রচলন করে সে তার এ কাজের সাওয়াব পাবে এবং তার পরে যারা তার এ কাজ দেখে তা করবে সে এর বিনিময়েও সাওয়াব পাবে। তবে এতে তাদের সাওয়াব থেকে কোনো অংশ কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে (ইসলামের পরিপন্থি) কোনো খারাপ প্রথা বা কাজের প্রচলন করবে, তাকে তার এ কাজের বোঝা (গুনাহ এবং শাস্তি) বহন করতে হবে। তারপর যারা তাকে অনুসরণ করে এ কাজ করবে তাদের সমপরিমাণ বোঝাও তাকে বইতে হবে। তবে তাদের অপরাধ ও শাস্তির কোনো অংশই কমানো হবেনা।”[4]
ফিকাহবিদদের মতে সুন্নাহ হলো:
السنة عند الفقهاء: ما ثبت عن النبي r من غير وجوب؛ فهي أحد الأحكام التكليفية الخمسة.
যে সব বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ওয়াজিব হওয়া ছাড়াই সাব্যস্ত হয়েছে। এটি শরী‘য়াহর পাঁচ প্রকার বিধানের একটি। সেগুলো হলো: ফরয, হারাম, সুন্নাত, মাকরূহ ও মুস্তাহাব।
উসূলবিদদের মতে সুন্নাহ হলো:
السنة عند الأصوليين: ما صدر عن النبي r غير القرآن الكريم من قول، أو فعل أو تقرير.
কুরআন ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও মৌন সমর্থনকে সুন্নাহ বলে।
মুহাদ্দিসীনদের মতে সুন্নাহ হলো:
السنة عند المحدثين: ما أثر عن النبي r من قول، أو فعل، أو تقرير، أو صفة، أو سيرة.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ, মৌন সমর্থন, তাঁর সাধারণ গুণাবলী বা তাঁর জীবন চরিতকে হাদীস বলে।
মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, শরী‘য়াহর বিধান বা রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার কার্যে যা কিছু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশ পেয়েছে, চাই তা তাঁর কথা বা কাজ বা মৌন সমর্থন যাই হোক এবং তা আমাদের পর্যন্ত সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মুসলমানদের জন্য দলিল ও শরী‘য়াহর মূলভিত্তি হিসেবে ধর্তব্য হবে। মুজতাহিদগণ এ থেকে শর‘ঈ বিধি-বিধান ও বান্দাহর আদেশ নিষেধ উদ্ভাবন করবেন।[5]
তৃতীয়ত: আল-ইজমা’ :
الإجماع: هو اتفاق جملة أهل الحل والعقد من أمة محمد r في عصر من الأعصار، على حكم واقعة من الوقائع».
ইজমা’ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদগণ কোনো এক যুগে শরী‘য়াহ এর কোনো এক বিধানের উপর একমত হওয়া।[6]
মুসলমানগণ একমত যে, ইজমা‘ শরী‘য়াহ এর দলিল, প্রত্যেক মুসলিমের উপর এ অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে ইজমা দলিল হওয়ার প্রমাণ:
আল-কুরআনে এসেছে:
﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]
‘‘কারো নিকট হেদায়াত প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব।’’ [সূরা আন-নিসা : ১১৫]
روي عن النبي r قال: «أمتي لا تجتمع على الخطأ، سألت الله ألا يجمع أمتي على الضلالة فأعطانيه، ومن سره بحبوحة الجنة فليتزم الجماعة، ومن فارق الجماعة قيد شبرٍ فقد خلع ربقة الإسلام من عقه».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমার উম্মত ভুলের উপর একমত হবে না। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি তিনি যেন আমার উম্মতকে ভ্রষ্টতার উপর কখনো একমত না করেন। ফলে আল্লাহ আমার দো‘য়া কবুল করেছেন। তাই যে জান্নাতের স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে চায় সে যেন জামা‘আতের সাথে থাকে। আর যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে সামান্য পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে তার ঘাড় থেকে ইসলামের রশিকে ছিন্ন করল (অর্থাৎ ইসলাম থেকে দূরে সরে গেল)”।[7]
চতুর্থ: আল-ক্বিয়াস:
القياس في اصطلاح الأصوليين: هو تسوية واقعة لم يرد نص بحكمها بواقعة ورد نص بحكمها في الحكم الذي ورد به النص لتساوي الواقعتين فل علة هذا الحكم.
কিয়াস হচ্ছে কোনো বিষয়ের জন্য সে বিধান নির্ধারণ করা, যে বিধান স্পষ্টভাবে অন্য একটি বিষয়ের জন্য কুরআন বা হাদীসে বর্ণনা করা আছে, উভয় বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানকারী ‘ইল্লাত’ বা হেতু থাকার কারণে।[8]
অধিকাংশ ফিকহবিদগণ একমত যে, কিয়াস শরীয়তের দলিল, এর দ্বারা আহকাম সাব্যস্ত করা হয়।
জমহুর উলামা কিরাম কিয়াস শরীয়তের দলিল হওয়ার অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে কয়েকটি হলো:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সাওম অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত উত্তরে বলেছিলেন:
" أَرَأَيْتَ لَوْ تَمَضْمَضْتَ بِمَاءٍ وَأَنْتَ صَائِمٌ؟
“যদি তুমি সাওম অবস্থায় কুলি করো তাতে কি সাওম ভঙ্গ হবে? (অর্থাৎ সাওম অবস্থায় পানি দিয়ে কুলি করলে যেমন সাওম ভাঙ্গে না, তেমনি স্ত্রীকে চুম্বন করলেও সাওম ভাঙ্গে না)। এটা ছিল রাসূলের পক্ষ থেকে উম্মতকে কিয়াস শিক্ষা দেয়া। কেননা এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম চুম্বনকে কুলির সাথে কিয়াস করেছেন। উভয়টিতেই সাওম ভঙ্গ হয় না। [9]
সাহাবা কিরামগণ শরীয়তের কিছু বিধান ইজতিহাদ করে বের করেছেন, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝে ছিলেন। তিনি তাদেরকে তিরস্কার করেননি। এটা ঘটেছিল যখন তিনি তাদেরকে আহযাবের যুদ্ধের দিন আসরের সালাত বনী কুরাইযাতে গিয়ে আদায় করতে নির্দেশ দেন। পথিমধ্যে আসরের ওয়াক্ত হলে তাদের কিছু সংখ্যক ইজতিহাদ করে পথেই সালাত আদায় করেন। তারা বললেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের থেকে সালাত বিলম্বে আদায় করা চাননি, বরং তিনি চেয়েছেন আমরা যেন দ্রুত বনী কুরাইযাতে যাই”। ফলে তারা রাসূলের আদেশের অর্থের দিকে লক্ষ্য করেছেন। অন্য দল শব্দের দিকে তাকিয়ে ইজতিহাদ করে আসরের সালাত বনী কুরাইযাতে গিয়ে বিলম্বে আদায় করেন।
যেসব ব্যাপারে স্পষ্ট নস পাওয়া যায় না সে ক্ষেত্রে কিয়াস হলো উক্ত মাস’আলার হুকুম উদঘাটনে প্রথম পদ্ধতি বা উপায়। এটা ইসতিম্বাতের ক্ষেত্রে খুবই স্পষ্ট ও শক্তিশালী পন্থা।
কিয়াস চারটি আরকানের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে:
১- আসল বা মূল মাস’আলা, যার হুকুমের ব্যাপারে নস এসেছে।
২- ফর‘আ তথা শাখা মাস’আলা, যার হুকুম মূল মাস’আলার উপর কিয়াস করে দেয়া হবে।
৩- আল-ইল্লাহ তথা কারণ, যে কারণের উপর ভিত্তি করে মূল মাস’আলার হুকুম এসেছে এবং এটা শাখা মাস’আলার মাঝেও পাওয়া যাবে।
৪- মূল মাস’আলার হুকুম। অতঃপর যদি উপরিউক্ত সব শর্ত সঠিকভাবে সর্বসম্মতভাবে পাওয়া যায় তবে তা সহীহ কিয়াস হবে, নতুবা কিয়াসটি ফাসিদ বলে গণ্য হবে। [10]
পঞ্চমত: আল-ইসতিহসান:
الاستحسان في اصطلاح الأصوليين القائلين به: هو العدول عن حكم اقتضاه دليل شرعي في واقعة إلى حكم آخر فيها؛ لدليل شرعي اقتضى هذا العدول… وهذا الدليل الشرعي المقتضي للعدول هو سند الاستحسان.
উসূলবিদদের মতে আল-ইসতিহসান হল, কোনো ঘটনায় একটি দলিলে শর‘য়ীর চাহিদা মোতাবেক যে হুকুম হয় তা না দিয়ে অন্য দলিলের চাহিদা মোতাবেক অন্য হুকুম দেয়া। এ শর‘য়ী দলীলটি – যা উক্ত মাস’আলার হুকুম থেকে বিরত রেখে অন্য হুকুম দিয়েছে – ইসতিহসানের সনদ তথা ভিত্তি। [11]
অন্য কথায়, ইসতিহসান হল একটি দলিলকে অন্যের উপর অগ্রাধিকার দেয়া, যা অগ্রাধিকার প্রদানকারী দলিলের বিপরীত হুকুম দেয়। কখনো কখনো এ প্রধান্যটা কিয়াসে যাহির তথা স্পষ্ট কিয়াস থেকে কিয়াসে খফী তথা অস্পষ্ট কিয়াসের দাবীর দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে হয়ে থাকে, বা ‘আম নসের উপর খাস নসের হুকুমের চাহিদার কারণে বা কুল্লী তথা সমষ্টিক হুকুমের উপর হুকমে ইসতিসনায়ী তথা কিছু সংখ্যকের উপর হুকুম দেয়ার দিকে প্রত্যাবর্তনের কারণে হয়ে থাকে।
وقال الإمام مالك: «هو القول بأقوى الدليلين».
ইমাম মালিক রহ. বলেছনে, দু’টি দলিলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দলিলের উপর আমল করাকে ইসতিহসান বলে।
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন, কিয়াসে খফীকে কিয়াসে জলী থেকে বা কুল্লী মাস’আলা থেকে জুঝয়ী মাস’আলাকে প্রধান্য দেয়া।[12] আরো পড়ুন
আপনি পড়ছেনঃ ইসলামী শরী‘য়াহর বাস্তবায়ন ও উম্মাহর উপর এর প্রভাব-থেকে
[1] উজুব তাহকিমুশ শারীয়াহ আল-ইসলামিয়া: পৃষ্ঠা নং ১১,১২।
[2] মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, উজুবু তাহকীম আশ-শরী‘য়াহ আল-ইসলামীয়াহ থেকে সংকলিত, পৃষ্ঠা: ১৬।
[3] বুখারী, হাদীস নং ৩৪৫৬, মুসলিম, হাদীস নং ২৬৬৯।
[4] মুসলিম, হাদীস নং ১০১৭।
[5] উজুব তাহকিমুশ শারীয়াহ আল ইসলামিয়া: পৃষ্ঠা নং ২০, ২১।
[6] আল-হুকমু বিমা আনযালাল্লাহ, পৃষ্ঠা: ৭২।
[7] আল-হুকমু বিমা আনঝালাল্লাহ, পৃষ্ঠা: ৭২। তবে এ হাদীসের প্রথম অংশ সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২০৯৩, এছাড়াও এ হাদীস বর্ণনা করেছে ইমাম আহমাদ ও হাকেম এ রয়েছে।
[8] মাসাদিরুত তাশরী’ ফিমা লা নসসা ফিহি, লেখক: আব্দুল ওয়াহহাব খাল্লাফ, পৃষ্ঠা নং ১৬।
[9] উসূলুশ শাশী: ১/১৩০।
[10] আল-মুসতাসফা ফি ইলম আল-উসূল, লেখক: ইমাম গাযালী: পৃষ্ঠা: ৪০৩।
[11] আল-হুকম বিমা আনযালাল্লাহ, পৃষ্ঠা: ৭৯।
[12] আল-হুকম বিমা আনযালাল্লাহ, পৃষ্ঠা: ৮০।