দৃষ্টিপাত বইটি আমি অনেকবার পড়েছি। কতবার হবে তা বলতে পারব না। বইটা পড়তে এখনও মন টানে। সাহিত্যের জন্য একাধিক বই না পড়ে প্রকৃত সাহিত্যের একটা বই বারবার পড়াই বেশি উপযোগী। লেখকের ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া বাকি সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করেছে। যাযাবর ছদ্মনামের এই লেখকের শব্দের গাঁথুনি আর বাক্য চয়ন এত চমৎকার যে, বইটি না পড়লে তা উপলব্ধি করা কঠিন। বইটির একজায়গায় তিনি নারীজাতির মূল্যায়ন করেছেন খুব রসালো ভঙ্গিমায়, রসাত্মক ভাষণে। যে কথাগুলো তিনি বলেছেন তারও অবশ্য একটা প্রেক্ষাপট আছে। লেখক একজন হিন্দু লোক হওয়া সত্ত্বেও ভারত উপমহাদেশের নারীরা কীভাবে বিদেশী সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বকীয়তা ও ধর্মীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন করল তা তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আলোচনা করেছেন। তার এসব মূল্যায়নে ধর্মীয় ছাপ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তিনি লিখেছেন-
‘পশ্চিমের শিক্ষা, সভ্যতা ও ভাবধারা আমাদের দেশে এনেছে নতুন আবেষ্টন। তার ফলে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের কর্মে এবং চিন্তায়। আমাদের আহার, বিহার, বসন-ভূষণ বদল হয়েছে। বদল হয়েছে রীতি-নীতি ও ধ্যান-ধারণা। এতকাল নারীকে কেবল আমরা পুরুষের আত্মীয় রূপেই দেখেছি। সে আমাদের ঠাকুমা, দিদিমা, পিসি, দিদি, বৌদি কিংবা শ্যালিকা। কিন্তু জায়া, জননী এবং অনুজা ছাড়াও নারীর যে আরও একটি অভিনব পরিচয় আছে, সে সম্পর্কে আমরা বর্তমানে সচেতন হয়েছি। তার নাম সখী (গার্লফ্রেন্ড)।
প্রাণীজগতের মতো মনোজগতের বিবর্তন আছে। তার ফলে বিভিন্ন বস্তু, ব্যক্তি বা নীতির মূল্য সম্পর্কে আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। নারীর মূল্যের যুগে যুগে তারতম্য হয়েছে। একদা সমাজে মায়ের স্থান ছিল সর্বপ্রধান। সেদিন পরিবার পরিচালনা থেকে বংশপরিচয় এবং উত্তরাধিকার নির্ণিত হত মাতার নির্দেশ, সংজ্ঞা ও সম্পর্ক দিয়ে। ক্রমে এই ম্যাট্রিয়ার্কল ফ্যামিলি বিলুপ্ত হলো। রাজমাতার চাইতে রাজরানীর মর্যাদা হল অধিক। সাধারণ পরিধি পরিমিত। সংসারের কর্ত্রী হলেন জননী নয় গৃহিণী। ছেলেরা মায়ের কোল ছেড়ে বউ-এর আঁচলে আত্মসমর্পণ করল।
বলা বাহুল্য, এই হস্তান্তরে মায়েরা খুশি হলেন না। কেউ কেউ অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ফল হল না। হার হল তাদেরই। শুধু বউকাঁটকি আখ্য পেয়ে নাটক, নভেলে তারা নিন্দিত হলেন। যারা বুদ্ধিমতী, তারা কালের লিখন পাঠ করলেন দেয়ালে, মেনে নিলেন অবধারিত বিধি। নিঃশব্দে-, কিন্তু স্বচ্ছন্দে নয়। জগতে সমস্ত বিক্ষুব্ধ মাতৃকুলের অনুরক্ত অভিযোগ আজও জেগে আছে বধুশাসিত আধুনিক গৃহের বিরুদ্ধে। ইউরোপ আমেরিকার সমাজে পত্নীকর্তৃত্ব পুরোপুরি স্বীকৃত। বিবাহের পর ছেলের সংসারে মায়ের স্থান নেই, কিংবা থাকলেও সে স্থান উল্লেখযোগ্য নয়।
এ যুগের পুরুষের কাছে ঘরের চাইতে বাইরের ডাক বেশি। সে দশটা পাঁচটায় অফিসে যায়, কারখানায় খাটে, শেয়ারমার্কেটে ঘোরে। সেখান থেকে টেনিস, রেস কিংবা মিটিং। রাত্রিতে সিনেমা অথবা ক্লাব। এর মধ্যে গৃহের স্থান নেই, গৃহিণীরও আবশ্যকতা নেই। আগে সস্ত্রীক ধর্মাচারণ হত। কিন্তু এখন শুধু ইলেকশনে ভোটসংগ্রহ ছাড়া ভারতবর্ষেও বড় একটা কাজে লাগে না। তাই এ-যুগে সহধর্মিনীকে নিয়ে বেশি রোমান্স লেখা হয়।
পুরুষের জীবনে আজ গৃহ ও গৃহিণীর প্রয়োজন সামান্যই। তার খাওয়ার জন্য আছে রেস্তোরাঁ, শোয়ার জন্য আছে হোটেল, রোগে পরিচর্যার জন্য আছে হাসপাতাল ও নার্স। সন্তান-সন্ততিদের লালন-পালন ও শিক্ষার জন্য স্ত্রীর যে অপরিহার্যতা ছিল, বোর্ডিং-স্কুল ও চিলড্রেনস হোমের উদ্ভব হয়ে তারও সমাধা হয়েছে। তাই স্ত্রীর প্রভাব ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে ঠেকেছে এসে সাহচর্যে। সে পত্নীর চাইতে বেশিটা বান্ধবী। সে কর্ত্রীও নয়, ধাত্রীও নয়- সে সহচরী।
নারীর পক্ষেও স্বামীর সম্পর্ক এখন পূর্বের ন্যায় ব্যাপক নয়। একদিন স্বামীর প্রয়োজন মুখ্যত ছিল ভরণ-পোষণ ও রক্ষাণাবেক্ষণের। কিন্তু এ যুগের স্ত্রীরা একান্তভাবে স্বামী- উপজীবিনী নয়। দরকার হলে তারা অফিসে খেটে টাকা আনতে পারে। তাই স্বামীর গুরুত্ব এখন কর্তারুপে নয়, বন্ধুরূপে।
ভারতবর্ষও এই নব ধারার বন্যাকে এড়িয়ে থাকতে পারে নি। ঢেউ এসে লেগেছে তার সমাজের উপকূলে। আমাদেরও পরিবার ক্রমশ ক্ষুদ্রকায় হচ্ছে, আত্মীয় পরিজনের সম্বন্ধ সঙ্কীর্ণ হচ্ছে। গ্রাম্য সভ্যতার ভিত বিধ্বস্ত, কলকারখানাকে কেন্দ্র করে নগর-নগরীর বি¯তৃতি ঘটেছে ধীরে ধীরে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন জীবন-ধর্মের উদ্ভব অপরিহার্য। এদেশের পুরুষের জীবনে এবার আভির্ভূত হয়েছে সখী (গার্লফ্রেন্ড) আর নারীর জীবনে সখা (বয়ফ্রেন্ড)।
অবশ্য লেখক মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্য তুলে ধরে বলেছেন, ‘কিন্তু সাধারণ হিন্দু পরিবারে অনাত্মীয়-স্ত্রী-পুরুষের বন্ধুত্বের পথ উন্মুক্ত নয়। সাধারণ মুসলিম পরিবারেও নয়। সেখানে বন্ধু বা বান্ধবীর স্বীকৃতি মাত্র নেই। সেখানে পুরুষের জীবনে প্রথমে যে অনাত্মীয়া নারীর সান্নিধ্য ঘটে, তিনি নিজের স্ত্রী।’
লেখক তার বক্তব্যে ভারতবর্ষে মুসলিম নারীদের মানসিক ও নৈতিকাবস্থার পরিবর্তন, পবিত্র সম্পর্কের বাইরেও অনৈতিক সম্পর্কের অনুপ্রবেশের ইতিহাস অত্যন্ত বাস্তবতার আলোকে উপস্থাপন করেছেন। সেই সাথে একথাও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মুসলিম পরিবারে অনৈতিক সম্পর্কের কোনো স্থান নেই। এখানে এধরনের সম্পর্ক অস্বীকৃত।
এটা লেখকের আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগের বিশ্লেষণ ও পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং একটি খাঁটি মুসলিম পরিবার সম্পর্কে ধারণা হলেও এখন অবস্থার বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন গুটিকয়েক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার ছাড়া নৈতিকতার এই শক্ত দেয়াল চোখে পড়ে না। কেবল পাশ্চাত্য সভ্যতা, পশ্চিমী ধ্যান-ধারণা আর পাশ্চাত্যীয় জীবনে অভিষেকের নির্দয় আস্ফালন। তাই ঘটছে হাজারও অপ্রীতিকর, জঘন্য ও নারকীয় ঘটনা। পাশ্চাত্যের সভ্যতার সুফল হিসেবে কখনও নারী সখা গ্রহণ করে স্বামীকে করছে পদধূলিত। আবার স্বামী কখনও গার্লফ্রেন্ড গ্রহণ করে নারীর জীবনকে করছে বিষাক্ত। বিষ আর অবিশ্বাসে ছেয়ে গেছে আমাদের সভ্যতা, আমাদের পবিত্র সম্পর্ক।
দিন যত যায় ঘটনার নির্মমতা তত বাড়ে। একদিন হয়ত স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করার খবর পাওয়া গেল তো পরের দিন পাওয়া গেল স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করার নির্মম দুঃসংবাদ। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন, আমাদের সভ্যতা, আমাদের জীবনসংসার!
এবারের ঘটনার নির্মমতা অন্য দশটি ঘটনা ছাড়িয়ে যায় কিনা তাই ভাবছি। মাত্র এক বছর হয় বিয়ে করেছেন যুবকটি। ডাক্তার হওয়ার বিরাট স্বপ্ন নিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন তার পদযুগলে চুম্বনও করেছিল। সেই চুম্বনের আর্দ্রতা শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে মৃত্যু এসে চুমো দিয়ে গেল। সে স্ত্রীর কল্যাণে (?)! স্ত্রী কয়েকজন লোককে ডেকে এনেছিলেন স্বামীর ‘মালাকুল মাউত’ হিসেবে!
মা বাবার অশেষ আশা-আকাঙ্ক্ষা, মেধা ব্যয়, অর্থবিত্ত খরচ করে একজন ডাক্তারকে সমাজে দাঁড়াতে হয়। এই যুবক তা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জীবনের সব সঞ্চয় ব্যয় করার সংকল্প করেছিলেন সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর জন্য। কিন্তু কোনো এক মায়ার টানে পড়ে গেলেন সেই স্ত্রী। মাত্র এক বছরের ক্ষুদ্র জীবনে স্বামীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের লাভা বিচ্ছুরিত হলো সেই স্ত্রীর অপবিত্র মনে। অপবিত্র বললাম একারণে যে, একজন স্বামী বা স্ত্রী যতই অপরাধ করুক না কেন তারা একারণে কেউ কারো থেকে প্রতিশোধ নিতে পারে না। দাম্পত্য জীবনে কত সমস্যা আসবে, ঝড়-ঝাপটা আসবে, কখনও মনে হবে এই বুঝি গেল রে! কিন্তু সব কিছু জয় করে সংসার নামের ভেলাটাকে গন্তব্যের ঘাঁটে পৌঁছাতেই হবে। তবেই না নারীর স্ত্রী হিসেবে এবং পুরুষের স্বামী হিসেবে সফলতা। এই সফলতা যে অর্জন করেছেন তিনি যেখানেই থাকুন না কেন আমি তাকে সম্মান করি। তার প্রতি আমার স্বশ্রদ্ধ সালাম!
যাহোক, এই স্ত্রীটি স্বামীকে জীবনপথের কাঁটা মনে করতে শুরু করলেন। জানি না কতদিন এই ‘কাঁটা’র সঙ্গে রাত যাপন করেছেন। ভালোবাসার অভিনয় করেছেন। মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই অভিনয় দীর্ঘায়িত করতে পছন্দ হচ্ছিল না তার। ফলে নিজের মনের মতো করে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ঘটনাটা সেপ্টেম্বর ২০১১ ইংরেজির। সেই দিনটার সমাপ্তির মধ্য দিয়ে আগমন ঘটল একটি নতুন রাতের, নতুন অধ্যায়ের। অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে ঘুমাতে গেলেন ডাক্তার ও সদ্য বিবাহিত লোকটি। কিন্তু স্ত্রীর মনে স্বস্তি নেই। এক অজানা কর্মতৎপরতা তাকে ব্যাকুল ও অস্থির করে রেখেছে। স্বামীশয্যায় কেবলই তিনি উসখুশ করছেন। আজকের রাতটা যেন তার কাছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা রাতের মতো চল্লিশ বছরের রাতের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। তবে সেই চল্লিশ বছরের সমান রাত যেমন শেষ হবে এই রাতটাও তেমন শেষ হওয়ার পথে এগিয়ে চলল।
রাত তখন মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছে। জোসনার আলো ছাপিয়ে ধরনী কেবলই নিকষ কালো হতে শুরু করেছে। রাতের কৃষ্ণতা আর নিস্তব্ধতার মধ্যে এগিয়ে চলল কয়েকটি বনী আদম, কাবিলের যোগ্য উত্তরসুরী। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালো তারা ডাক্তার বাড়ির আঙিনায়। মৃদু করাঘাত করল তারা দরজায়। মধ্য রাতের সামান্যতম এই আওয়াজ ঘুমে বিভোর ও স্ত্রীপরশে শয্যাযাপিত ডাক্তার সাহেবের কানে যাওয়ার কথা না। কিন্তু একজন লোক এমন একটি ক্ষীণ শব্দ শোনার জন্যই রাতের শুরু থেকে অধির অপেক্ষায় কালক্ষেপন করছিলেন। তাই শব্দটা শোনামাত্রই ঝড়ের বেগে এসে দরজা খুলে দিলেন তিনি। আগন্তুকদেরকে ঘরে অভ্যর্থনা জানালেন পরমভক্তিভরে।
এরপর ইশারা করলেন বিছানায় পড়ে থাকা নিরাপরাধ লোকটির দিকে। লোকগুলো খুব তাড়াবোধ করছিল। দেরি করল না তারা। ঘুমের বেঘোরে থাকা লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ। কয়েক মিনিটের ঘটনা। অপ্রস্তুত অসহায় লোকটি নিজেকে প্রাণঘাতী দুশমনের বেষ্টনে আবদ্ধ দেখতে পেলেন। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছেন স্ত্রী। ঘুমের ঘোরে বুঝতে না পেরে তার কাছে সাহায্য চাইতে উদ্যোত হলেন। কিন্তু মৃত্যুর আতংক যখন তার ঘুমের ঘোর কাটিয়ে দিয়েছে তখন দেখলেন স্ত্রী আজ তার সহায়ক নয়, হন্তারকদের পথপদর্শক! স্ত্রীর কাছে সাহায্য চাওয়া প্রহসন ভেবে নিবৃত হলেন তিনি। একাই কতক্ষণ লড়াই করলেন। এরপর চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী দুর্বল বলে সবলের, মজলুম বলে জালেমের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। খুনিরা বিজয়ীবেশে স্ত্রীর সামনে হাজির হলো। সদ্যসমাপ্ত হত্যা অভিযানের ‘বিজয়ী বীরদের (?)-কে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উপায়ে পুরুস্কৃত করল স্ত্রী!
এই প্রথম শুনলাম, স্বামীর হন্তারকদেরকে স্ত্রী ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানালেন ও পুরুস্কৃত করলেন!
আপনি পড়ছেনঃ মুক্তবাসিনী ২ বই থেকে।
The post স্বামীর হত্যাকারীদেরকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ ও পুরুস্কৃত করেছেন স্ত্রী appeared first on Amar Bangla Post.