ভালোবাসা দিবসের আবিষ্কারকরা পিছু হটতে শুরু করেছেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি যারা বিশ্বভালোবাসা দিবস পালন করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন তাদেরকেও আশাহত হতে হয়েছে। আসলে ফেব্রুয়ারির এই সপ্তাহটি ছিল ঘটনাবহুল, হৃদয়বিদারক এবং কষ্টের সপ্তাহ। ১১ই ফেব্রুয়ারি নিমর্মভাবে নিহত হন দুই সাংবাদিক, সাগর এবং রুনি। তারা স্বামী-স্ত্রী। মাত্র পাঁচ বছরের একটি শিশু মেঘ। তার সামনেই সন্ত্রাসীরা পিতামাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মা-বাবার রক্তভেজা মোবাইল থেকে পরের দিন মেঘ তার নানুর কাছে ফোন দিয়ে বলে ‘আব্বু আম্মু মারা গেছে।’
এমন একটি নির্মম দুঃসংবাদ শোনার প্রস্তুতি ছিল না তার মা-বাবার। ছিল না গোটা দেশবাসীরও। তাই শোকে কাতর হয়েছে সবাই। সেদিন শোকে সবাই মেঘ হয়ে গিয়েছিল। সাগর-রুনি যেন শুধু মেঘেরই মা-বাবা নন গোটা দেশবাসীর মা-বাবা। তারা শুধু তার মা-বাবারই সন্তান নন গোটা দেশবাসীর সন্তান। এই ঘটনায় ‘বহিরাগতদের’ মধ্যে সবচেয়ে বেশি চটেছিলেন সাংবাদিক শ্রেণী। কারণ, সাগর-রুনি দুইজনই ছিলেন তাদের সহকর্মী-সাংবাদিক। সাংবাদিকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আর উত্তেজনা দেখে আমাদের হম্বতম্বী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের বের করার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন।
মন্ত্রী হম্বতম্বী করতে ভালোবাসেন। যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভালো বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন। জনগণ কতটুকু আশ্বস্ত হয় জানি না, কিন্তু আশ্বস্তাবোধ সৃষ্টির চেষ্টায় ত্রুটি থাকে না তার। সেই চেষ্টার ধারাতেই ৪৮ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের খুঁজে বের করার চরম আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে কয়েক ‘শত ৪৮ঘণ্টা’ গত হওয়ার পর হার মেনেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, তার ভুলে হয়েছে। সাংবাদিকদের চাপে পড়ে ৪৮ঘণ্টার সময় বেঁধে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। যাহোক, তার বেঁধে দেয়া এই সময়ের মধ্যে খুনের রহস্য উদঘাটিত করা সম্ভব হয় নি।
আইনের হাত আর চিন্তা নির্দিষ্ট গন্তব্য তথা ঘটনার ক্লু পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম না হলেও মানুষের কল্পনা শক্তি অনেক ক্ষেত্র থেকে বিচরণ করে এসেছে। কেউ কেউ এখানে অবৈধ সম্পর্কের গন্ধ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ১৩ তারিখের বিডিনিউজ টুয়েন্টফোর ডটকম সে রকম একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। ঘটনাপ্রবাহে মনে হয় হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘুরানোর জন্যই এধরনের তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। আসলে কথা হচ্ছে, প্রেম-পরকীয়ার বিষয়টা এত ব্যাপকতা পেয়েছে যে, মানুষ এখন এটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পার পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটাও কিন্তু কম খারাপ ব্যাপার নয়!
ঘটনা যাই হোক, হয়ত ভালোবাসা দিবসের আয়োজকরা এতে ভড়কে গেছেন। প্রেম-ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে যেখানে আবির্ভূত হচ্ছে নিত্য হৃদয়বিদারক ঘটনা সেখানে এই শোকের মধ্যে আর দিবসটি পালন করার সাহস করেন নি। ‘বিশ্ব ভালোবাসা পালন কমিটি’ ১৪ তারিখে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের বুদ্ধির শুভোদয় হোক। আগত প্রতিটি ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে যেন তাদের এই শুভবুদ্ধি সক্রিয় থাকে।
কিন্তু যে পাপের দরজা তারা একবার জাতির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সেই দরজা দিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে পাপ প্রবেশ করছে। চিনি কলের মতো। বছরে একবার চালু করে দিলে একগতিতে ছয় মাস পর্যন্ত চলতে থাকে! নিত্য চালু করতে হয় না। ঠিক এভাবেই ভালোবাসা দিবস, উন্মুক্ত প্রেমচর্চা ইত্যাদিতে একবার গতি সঞ্চার করে দিয়ে পাপের যে যাত্রা চালু করে দেয়া হয়েছে ভালোবাসা দিবস মাত্র একবছর বন্ধ রাখলেই কি সে ধারা শেষ হয়ে যাবে?
এত সহজে যে তা শেষ হবার নয় তার প্রমাণ গত বছরের ১৪ই ফেব্রুয়ারির একটি অতি মর্মান্তিক ঘটনা। সাংবাদিক দম্পতির মর্মান্তিক ঘটনার রেশ না কাটতেই দেশবাসী জানতে পারল আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার ইতিকথা। আসলে ভালোবাসা বা ভ্যালেন্টাইন দিবসটা এসেছিল পাপের হাত ধরেই। তাই পাপ আর মর্মান্তিক উপাখ্যানের সাথে এর এত গলাগলি। গত বছরও এই দিবসকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল একটি মর্মান্তিক ঘটনা। ‘ভালোবাসার নীলগোলাপ’ শিরোনোমে যা মুক্তবাসিনী-১ এ উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু এবারও যে এই দিনকে কেন্দ্র করে লিখতে হবে এবং আগের চেয়েও অনেক করুণ স্বরে তা ভাবিনি কখনও।
মাত্র নবম আর দশম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী এমন মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিতে পারে তা ভাবার জন্য যতটুকু কল্পনাশক্তি থাকা দরকার সম্ভবত তা আমাদের অনেকেরই নেই। তাই এসব ঘটনার কথা কখনও কল্পনা করি না আমরা এমনকি সংঘটিত হওয়ার পরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
আত্মহত্যার রকমফের আছে। মানুষ বহু উপায়ে আত্মহত্যা করে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া জীবনের আমানত নষ্ট করে নিজেকে অকল্যাণের পথে দ্রুত অগ্রসর করে। আত্মহত্যার যতগুলো উপায় মানুষ অবলম্বন করে সেগুলোর প্রত্যেকটির কথা হাদীসে উল্লেখ করে এরজন্য কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
« مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيدَةٍ فَحَدِيدَتُهُ فِى يَدِهِ يَتَوَجَّأُ بِهَا فِى بَطْنِهِ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِسُمٍّ فَسُمُّهُ فِى يَدِهِ فِى جَهَنَّمَ يَتَحَسَّاهُ فِى نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا وَمَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَهُوَ يَتَرَدَّى فِى جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيهَا أَبَدًا».
‘যে ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে সেই অস্ত্র তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সে সেই অস্ত্র দ্বারা চিরকাল নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামে চিরদিন সেই বিষ পান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামে (-র আগুনের পাহাড় থেকে) এভাবে লাফিয়ে পড়ে পড়ে কষ্ট ভোগ করতে থাকবে।’ [বুখারী : ৫৭৭৮; মুসলিম : ৩১৩]
আত্মহত্যার সব সংজ্ঞা ভুল প্রমাণ করে বেনযীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করল দুটো পুচকে ছেলেমেয়ে। আর তা শুধুই ভালোবাসা নামের ভণ্ডামির কারণে।
ঘটনাটি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠিবাজারের। ঘটনার নায়ক-নায়িকা মিতু খানম ও সাউথ শেখ। কাঠি গ্রামের আলহাজ এনজেল শেখের ছেলে মিরপুর বাংলা এন্ড স্কুল কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্র সাউথ শেখের সাথে খেলনা গ্রামের মৃত জাহিদ হোসেনের মেয়ে মিতু খানমের ‘দীর্ঘদিনের’ প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
আচ্ছা পাঠক! আপনিই ইনসাফের সাথে বলুন তো, এই দশম শ্রেণীর দুজন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ‘দীর্ঘদিন’ ধরে যদি প্রেমেরই সম্পর্ক থাকে তাহলে ওরা লেখাপড়ার কাজটা করেছে কখন? এ যুগে তো ছেলেমেয়েরা ‘আন্ডাবাচ্চা’ থাকতেই স্কুলে ছোটে। ১৪/১৫ বছরে পৌঁছে যায় নবম-দশম শ্রেণীতে। তাহলে এই শ্রেণীর এই বয়সীর দুটো ছেলেমেয়ের ‘দীর্ঘদিন’ যদি কাটে প্রেমের সম্পর্কে তাহলে প্রেম ছাড়া অবশিষ্ট কাটল কতদিন?
তা যাহোক, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কোনো পরিবারেই এটাকে পাত্তা দেয়া হয়নি এবং তাদের ‘প্রেম-ভালোবাসাকে’ স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ছেলেবয়সী ছেলেমেয়েদের ছেলেখেলা বন্ধ ও তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্য এক বছর আগে সাউথকে কাঠি স্কুল থেকে সরিয়ে ঢাকার মিরপুরে ভর্তি করে দেয়া হয়। এদিকে গত ১৪ই জানুয়ারি ঢাকায় মিতুর মামা মুজিবুর রহমান শেখের বাসায় মোমেনশাহীর এক ছেলের সাথে মিতুকে বিয়ে দেয়া হয়।
এখানেই পূর্বের সম্পর্কের ছেদ পড়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসা উচিত-অনুচিত মানে? বিশেষ করে এই ‘নাবালেগ’ বয়সে? ফলে অনুচিত কাজের হাত ধরেই বিয়ের পরও বিপুল উদ্যমে চলতে থাকে তাদের ভালোবাসা। এজন্য তারা আশ্রয় নিয়েছিল মোবাইলের। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তায় ঢাকার মামার বাড়ি থেকে খেলনা গ্রামের বাবার বাড়িতে চলে আসে মিতু। এদিকে ঘটনার আগের দিন রাতে নাইট কোচ যোগে রাত দুইটার সময় কাঠিবাজারে এসে নামে সাউথ।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ভোর ৫টায় মিতু ও সাউথ স্কুলসংলগ্ন গ্রামীণফোনের টাওয়ারে ওঠে। মোবাইলে সাউথ বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে টাওয়ারে চড়ার কথা জানায় এবং তাদের প্রেম মেনে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব করে। অন্যথায় সে টাওয়ার থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলে না। সাড়া দেয়ার কথাও না। যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছে, অন্যের ঘর করছে তাকে নিজ স্বামীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আরেকজনের হাতে তুলে দেয়ার মতো বেইনসাফ ও নিকৃষ্ট কাজ কেউ করতেও যাবেন না।
পারিবারের তরফ থেকে সাড়া না পেয়ে মিতুর পরনের ওড়না দিয়ে পরস্পরে দুইজনের হাত বেঁধে ২৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে একসাথে লাফিয়ে পড়ে তারা। এত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ায় তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে ও ফেটে যায়। স্রোতের আকারে রক্ত প্রবাহিত থাকে। বিকট শব্দে তারা মাটিতে আছড়ে পড়ে। ২৮০ ফুট উঁচু থেকে তাদের যুগল দেহ যখন মাটিতে এসে পৌঁছায় তখন পতনের বিকট শব্দ হয়। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। কিন্তু সহমর্মিতা দেখানো, চিকিৎসা দেয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে বড্ড অসময়ে থেমে যায় দুটি স্বপ্নের উচ্ছল পথচলা। ভাঙাচোরা দেহের প্রবাহিত রক্তে গড়াগড়ি করতে থাকে দুটি কিশোরপ্রাণ। [আমার দেশ ১৫/০২/১২]
আমরা ভালোবাসার মানুষের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করি। ২৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে হাত ধরাধরি করে লাফ দিয়ে জীবন বিসর্জন দিতে পারি। অস্থায়ী মোহের কিঞ্চিত উম্মাদনায় কত কিছুই না করে দেখাচ্ছি। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা, নিখাঁদ প্রেম যেখানে করা যায়, যাদের সাথে করা যায় সেখানে কি নূন্যতম প্রেম-ভালোবাসা আমার প্রদর্শন করতে পারছি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আমাদের ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু? সাহাবায়ে কেরামের সাথে আমাদের ভালোবাসার তফাৎটা একটু পরিমাপ করে নেবো? সাহাবী আনাস রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى قِيَامُ السَّاعَةِ فَقَامَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- إِلَى الصَّلاَةِ فَلَمَّا قَضَى صَلاَتَهُ قَالَ « أَيْنَ السَّائِلُ عَنْ قِيَامِ السَّاعَةِ ». فَقَالَ الرَّجُلُ أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ « مَا أَعْدَدْتَ لَهَا » قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَعْدَدْتُ لَهَا كَبِيرَ صَلاَةٍ وَلاَ صَوْمٍ إِلاَّ أَنِّى أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ». فَمَا رَأَيْتُ فَرِحَ الْمُسْلِمُونَ بَعْدَ الإِسْلاَمِ فَرَحَهُمْ بِهَذَا.
জনৈক বেদুইন এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের জন্য দাঁড়ালেন এবং সালাত শেষ করে বললেন, কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়? লোকটি বললেন, এই যে আমি ইয়া রাসূলাল্লাহ। তখন তিনি বললনে, তুমি কেয়ামত দিবসের জন্য কতটুকু প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এর জন্য দীর্ঘ সময় সালাত পড়িনি এবং তেমন রোযাও পালন করিনি। কিন্তু আমি আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূলুল্লাহকে ভালোবাসি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মানুষ তার ভালোবাসার লোকের সাথে থাকবে। আর তুমিও যাকে ভালোবাসো তার সাথেই থাকবে। আনাস রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই কথা শোনার পর মুসলিমগণ সেদিন যে পরিমাণ খুশি হয়েছিলেন, তাদেরকে আমি এর চেয়ে বেশি খুশি হতে দেখিনি কখনও। [তিরমিযী : ২৫৬০]
সাহাবায়ে কেরামের ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি আবর্তিত হতো আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা-মহব্বতকে কেন্দ্র করে। আমাদের বেলায় কি তাই হয়? আমরা একই নবীর একই উম্মত নই? তাদের ভালোবাসার অন্তত দশভাগের এক ভাগ তো থাকা চাই। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
« إِنَّكُمْ فِى زَمَانٍ مَنْ تَرَكَ مِنْكُمْ عُشْرَ مَا أُمِرَ بِهِ هَلَكَ ثُمَّ يَأْتِى زَمَانٌ مَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ بِعُشْرِ مَا أُمِرَ بِهِ نَجَا ».
‘তোমরা যে যমানায় অবস্থান করছো সে যমানায় আদিষ্ট বিষয়ের নয় ভাগ পালন করে একভাগ তরক করলেও ধ্বংস হবে। আর এমন একটি যমানা আসবে যখন মানুষ আদিষ্ট বিধানের দশ ভাগের মাত্র একভাগ পালন করলেও নাজাত পাবে।’ [জামে তিরমিযী : ২৪৩৬, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘গরীব’ এবং শায়খ আলবানী ‘যঈফ’ বলেছেন।]
তাহলে বলুন, অন্তত যে একভাগ পালন করলে নাজাতের ঘাটে পৌঁছতে পারব সেই পরিমাণ নবীপ্রেম দ্বারা আমরা হৃদয়কে সিক্ত করতে পারছি? নবীর ভালোবাসা কি ফরয নয়? নবীর ভালোবাসা ছাড়া আখেরাতের পরীক্ষায় উৎরানো যাবে? ভালোবাসার সবটুকু মানুষের পেছনে উজাড় করে দিয়ে রিক্তহস্তে মরুসম তৃষ্ণা নিয়ে যদি হাউজে কাউসারের সামনে হাজির হই তবে সেখানে কীসের নযরানা পেশ করব? ভালোবাসার শূন্য পেয়ালায় যে সেদিন পানি উঠবে না!
লেখাটি যেদিন লিখছিলাম সেদিনই শুনলাম আরেক লোকের ঘটনা। আকৃতি খর্ব, মুখে দুর্গন্ধ, বর্ণে কৃষ্ণ এক মহিলার প্রেমে পড়ে মুসা নামের এক যুবক দিওয়ানা হয়ে গেলো। বেশ কিছুদিন গড়ালো এই সম্পর্ক। তবে চূড়ান্ত সম্পর্ক গড়ানোর আগেই মেয়েটি পিছুটান দিলো। সে সম্পর্ককে দীর্ঘায়িত করতে নারাজ। মুসা বহুদিন আল্লাহ তা‘আলার দরবারে রোনাজারি করল। চাইল তাকে তার কাছে মন খুলে। তবু তার চাওয়া পূর্ণ হলো না। মেয়েটি তার কাছে ফিরে এলো না। ফলে মুসার সব রাগ গিয়ে পতিত হলো সৃষ্টিকর্তার ওপর! তিনি কেন তাকে ফিরিয়ে দিলেন না সেই রাগে তাকে অস্বীকার করে বসল সে! যাকে বলে মুরতাদ হয়ে যাওয়া। যে যুবকএক সময় তাহাজ্জুদ পড়ত সেই যুবক এখন নাকি আল্লাহ তা‘আলার নামও আর কোনোদিন মুখে নিবে না!
মুসা! তুমি তোমার তাহাজ্জুদের জায়নামাজকে কেন ‘তুর পাহাড়ে’ পরিণত করতে পারলে না? হৃদয়ে আল্লাহর ভাষার ঝড় তুলতে পারলে না? এত কষ্ট করে যেহেতু তাহাজ্জুদের জায়নামাযে দাঁড়িয়েছই, তখন মনটাকে ‘মুসার আল্লাহদর্শন’র ব্যগ্রতায় আকুল করতে পারলে না? তবে অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে, যাকে তুমি চাও আর তিনি যাকে তোমার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন তার মধ্যে ব্যবধান কত? আমরা হয়ত জায়নামাযে দাঁড়াই নির্দেশ পালন করে কোনো মতে দায়মুক্ত হতে, কিন্তু ইবাদতের আসল উদ্দেশ্য- আল্লাহ ও রাসূলের ভালবাসা- আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকে। তাই আমরা হৃদয়টাকে মানবপ্রেম দিয়ে ভরাট করে রেখে যখন জায়নামাযে দাঁড়াই তখনও দৃষ্টি থাকে বাইরে। প্রেমাস্পদের হৃদয়গলিতে চক্কর খেতে থাকে আমার মন! সালাত শেষ করে যখন উঠি তখন আমলনামায় হয়ত নিরস কয়েকটি রুকু-সিজদা ছাড়া আর কিছু লিপিবদ্ধ হয় না।
ভালোবাসাশূন্য এই ইবাদত করে যখন আমরা কাঙ্ক্ষিত জাগতিক ফল পেতে ব্যর্থ হই তখনই আল্লাহর বিরুদ্ধে খেপে যাই! কেউ বা তাকে আর ডাকবেই না বলে দাম্ভিক ঘোষণা দেয়! এই দাম্ভিক ঘোষণার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের ব্যর্থ বণিকে পরিণিত করে। বঞ্চিত হয় প্রভুর ভালোবাসা থেকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَن يَرۡتَدَّ مِنكُمۡ عَن دِينِهِۦ فَسَوۡفَ يَأۡتِي ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ يُحِبُّهُمۡ وَيُحِبُّونَهُۥٓ ٥٤ ﴾ [المائدة: ٥٤]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তার দ্বীন থেকে সরে যায় তাহলে অতিসত্ত্বর আল্লাহ তা‘আলা এমন একদল সৃষ্টি করবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাকে ভালোবাসবে।’ {সূরা আল-মায়েদা, আয়াত : ৫৪}
আমরা কি তবে নারীর ভালোবাসায় পড়ে এমন সৌভাগ্যবানদের কাতার থেকে বাদ পড়ব, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসেন? এত বড় ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা আমরা দেখাবো?
যুগে যুগে এমন বণিক বহু এসেছে আর জীবন উপসংহারে আক্ষেপের হাত কামড়াতে কামড়াতে রিক্তহস্তে বিদায় গ্রহণ করেছে। এমনি এক ব্যর্থ বণিক হলেন জাবাল্লা ইবন আয়হাম গাস্সানী। ইসলাম গ্রহণ করার পর হজ্বের তাওয়াফ করার সময় ফাযারা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার চাদর পদধূলিত করায় তিনি তাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে নাক ফাটিয়েছিলেন এবং দুটি দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এক এলাকার গভর্নর। তাই আইনের হাত থেকে ফসকে যাবেন বলে ভেবেছিলেন।
কিন্তু খেলাফতের মসনদে তখন ন্যায়-ইনসাফের জীবন্ত প্রতীক সাহাবী ‘উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু সমাসীন। তিনি মজলুম ব্যক্তিকে মাফ অথবা প্রতিশোধ নেয়ার ইখতিয়ার দিলেন। কিন্তু লোকটি দ্বিতীয়টি বেছে নেয়ায় জাবাল্লা বললেন, আমি একজন শাসক, আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ! মনে মনে একথা ভেবে একদিনের জন্য সময় চেয়ে নিলেন তিনি। এরপর চোক্ষুলজ্জার ভয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলেন আল্লাহদ্রোহিতার চোরাবালিতে। পালিয়ে নাক আর দাঁত বাঁচাতে পারলেন বটে, কিন্তু ঈমান বাঁচাতে পারলেন না। জীবনের শেষ বেলায় এর জন্য আক্ষেপ কম করেন নি তিনি। আক্ষেপের কাব্যে কেটেছে তার অবশিষ্ট জীবন। তিনি বলেছিলেন-
تنصرت بعد الحق عاراً للطمة … وما كان فيها لو صبرت لها ضرر
وأدركنى فيها لجاج حمية … فسيقت لها العين الصحيحة بالعور
فيالت أمى لم تلدنى وليتنى … صبرت على القول الذى قاله عمر
‘হক (ইসলাম) গ্রহণ করার পর ঘুষি খাওয়ার ভয়ে খ্রিস্টান হলাম,
যদি তাতে ধৈর্য ধারণ করতাম, তবে তাতে কীইবা ক্ষতি হতো!
কিন্তু আত্মগরিমার হঠকারিতা পেয়ে বসল আমায়
ফলে সুস্থচোখের বদলায় বক্র-কানা চোখ গ্রহণ করলাম।
হায় আক্ষেপ! আমার মা যদি আমাকে জন্ম না দিতেন!
কিংবা ‘উমর যা বলেছিলেন তা মনেপ্রাণে মেনে নিতাম!
রক্তমাংসের ভালোবাসার টানে কি তবে আমরা আল্লাহর শাশ্বত ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবো? বঞ্চিত হবো ইলাহী ‘পণ্য’ থেকে?
« أَلاَ إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ غَالِيَةٌ أَلاَ إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ الْجَنَّةُ ».
‘শুনে রেখো, আল্লাহ তা‘আলার পণ্য অনেক মূল্যবান। শুনে রেখো, আল্লাহর পণ্য হলো জান্নাত। [জামে তিরমিযী : ২৬৩৮]
মুসা! প্রণয়ভঙ্গ করে ফিরে এসো আপন নীড়ে! আসমানী শামিয়ানার নিচে ভালোবাসার যে প্রস্রবণ আছে তাতে অবগাহন করো। জাবাল্লাদের খাতায় নাম লিখিয়েদের সংখ্যা আর বাড়িও না। পাছে আক্ষেপে পুড়তে হবে কিন্তু!
মানুষের স্বভাবে ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতির উপাদান আছে একথা সত্য। তাই হৃদয় ফুঁড়ে ভালোবাসার উদ্গীরণ ঘটবেই। কিন্তু তা যেন কোনো অপাত্রে না পতিত না হয় এজন্য দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা উত্তম ব্যবস্থাও প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসো, তার রাসূলুল্লাহকে ভালোবাসো। মা-বাবা ও আত্মীস্বজনকে ভালোবাসো। ভাবছো এঁদের ভালোবাসায় তো আবেগ, উচ্ছায় প্রকাশ করা যায় না? শ্রদ্ধার ভাগটা বেশি থাকে। তাহলে হৃদয়ে জমাটবাধা আবেগ, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে কোথায়?
কোনো চিন্তা নেই। এর জন্য আছে তোমার অর্ধাঙ্গিনী। পৃথিবীর হেন কোনো আবেগ, উচ্ছ্বাস নেই, যা তার কাছে ব্যক্ত করা যায় না। শুধু ব্যক্তই নয় বরং তাতে সওয়াবও আছে অনেক। তার সাথে হাসি-মশকরা করবে? তাতেও সওয়াব। মুখে গ্রাস তুলে দেবে? তাতেও সওয়াব। উদ্বেলিত হৃদয়ে, উচ্ছ্বসিত মনে দাম্পত্যাচারণ করবে? কপালে চুম্বন করবে? তার ত্বকে তোমার চুম্বনের স্পর্শ পৌঁছার আগেই আমলনামায় সওয়াব লেখা হবে! অবাক হচ্ছো বুঝি! সত্যিই তাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দাম্পত্য সম্পর্কের মাধুর্য্য শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর পবিত্র আমলের মাধ্যমে। মা আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ يُقَبِّلُ بَعْضَ أَزْوَاجِهِ ثُمَّ يُصَلِّي وَلاَ يَتَوَضَّأُ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কোনো একজন স্ত্রীকে চুম্বন করে সালাত পড়তে গেছেন। মাঝখানে অযু করেননি।’ [নাসাঈ : ১৭০, সহীহ]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আম্মাজান আয়িশা সিদ্দীকা রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহা বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُ أَزْوَاجَهُ وَهُوَ صَائِمٌ ثُمَّ ضَحِكَتْ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাওম অবস্থায় তাঁর কোনো স্ত্রীকে চুম্বন করলেন। এরপর (আয়িশা রাদিআল্লাহ তা‘আলা আনহা স্ত্রীগণের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রীতি, ভালোবাসা, মায়া-মমতা ইত্যাদির কথা ভেবে এবং তিনি যে তাঁকেই চুম্বন করেছিলেন সে কথা স্মরণ করে) মুচকি হাসলেন। [বুখারী : ১৯২৮]
এভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত এই পবিত্র বন্ধনকে মাধুর্য্য দান করেছিলেন। সালাতের আগেও, সাওম রেখেও স্ত্রীর সাথে যে মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক বিনিময় করা যায় তিনি সেই আদর্শই শিক্ষা দিয়েছেন এসব ঘটনায়। কে না বলবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এসব আমলে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ? আমরা সেই আদর্শ গ্রহণে আদিষ্ট?
তুমি নারীর সাথে খুনসুটি করতে চাও? হাসি-মশকরা করে সময়টাকে রাঙিয়ে তুলতে চাও? তবে এখানেও ইসলামের আদর্শের আশ্রয় নাও। করো এসব বিবাহিত স্ত্রী, বৈধ নারীর সাথে। প্রতি মুহূর্তে সওয়াব। কথায় কথায় সওয়াব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُلُّ شَيْءٍ يَلْهُو بِهِ الرَّجُلُ بَاطِلٌ، إِلَّا رَمْيَةَ الرَّجُلِ بِقَوْسِهِ، وَتَأْدِيبَهُ فَرَسَهُ، وَمُلَاعَبَتَهُ امْرَأَتَهُ، فَإِنَّهُنَّ مِنَ الْحَقِّ .
‘তিনটি ছাড়া মানুষের সব রকমের ক্রিয়া-কৌতুক, খেল-তামাশা অবৈধ। তীর নিক্ষেপ করা, যুদ্ধের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত করা এবং স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশা, হাসি-মশকরা করা। কেননা এগুলো সত্য ও সওয়াবযোগ্য।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১৭৩০০]
বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীদের মধ্যে যে ভালোবাসা দান করেছেন তা নিখাঁদ, বাস্তব ও যুক্তিনির্ভর। ইরশাদ হয়েছে-
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]
‘আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গীনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি পাও। এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক দয়া ও ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত : ২১}
সত্যি স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা নিখাদ, অপূর্ব এবং লৌকিকতামুক্ত। আর হবেই না কেন? এই ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা! যে ভালোবাসার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা সেই ভালোবাসায় রহমত থাকবে না কেন? পক্ষান্তরে মানবরচিত কৃত্রিম ভালোবাসা দেখো। অবিবাহিত একজন নারী পুরুষকে কিংবা পুরুষ নারীকে ভালোবাসার অনেক গল্প শোনাবে, স্বপ্নের তুলিতে জীবনরুমালটাকে রাঙিয়ে তুলবে। কিন্তু যখন ‘চাইনিজ খাওয়ার’ সময় হবে তখন কিন্তু তোমার পকেটের স্ফীতি-অস্ফীতি দেখবে না! তোমার সামর্থের বিচারও সে করবে না। এদের ভালোবাসার শুরু রূপ দিয়ে আর শেষ পকেট দিয়ে! কিন্তু তোমার স্ত্রী? সে কখনও সাধ্যের বাইরে তোমার ওপর কিছু চাপাবে না। আগে দেখবে তোমার সামর্থ্য, তারপরে তার বায়না। কয়টা বলব? প্রকৃত ও কৃত্রিম ভালোবাসার পার্থক্যের এমন হাজারও নযীর বিদ্যমান। জ্ঞানীরা তো এত নযীর তালাশ করে না সেটা আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতের শেষেই বলে দিয়েছেন-
إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ
‘এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন।’ {রূম : ২১}
মনে রেখো, ইসলামে কোনো সংকীর্ণতা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, এবং যা কঠিন তা চান না। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৫}
তো আল্লাহ তা‘আলার বিধান যেখানে এত সহনীয়, তার বিধানের আওতায় থেকে বিনোদনেও রয়েছে প্রতিদান সেখানে আমাদের বক্রপথে যাওয়ার প্রয়োজন কী?
মনে রেখো, সর্বাগ্রে ভালোবাসতে হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলুল্লাহকে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি শুয়ে আছেন মদীনার পবিত্র মাটিতে। কিন্তু আছেন আমাদের হৃদয়কন্দরে, যদি আমরা তা অনুধাবন করার চেষ্টা করি। মুআযকে উদ্দেশ্য করে বলা তার একটি কথায় সে তথ্যই ফুটে উঠেছে। ঘটনাটি সংক্ষেপে বলি-
সাহাবী মুআয ইবন জাবাল রাদিআল্লাহু ‘আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামানের শাসক করে পাঠালেন এবং তাকে বিদায় জানাতে নিজে উপস্থিত হলেন। সে সময় তাকে স্বীয় উটনীর ওপর আরোহণ করালেন। দূর ইয়ামানের উদ্দেশ্যে উটনী চলা শুরু করলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি তার সাথে চললেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন এটা হচ্ছে প্রিয় সাহাবীর সাথে তার জীবনের শেষ দেখা এবং তার এই প্রিয় শিষ্য বহুদূরে চলে যাচ্ছেন। সাধারণত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের খুব কম স্থানেই আবেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সাহাবী মুআয ইবন জাবাল রাদিআল্লাহু ‘আনহুর সাথে তার বিশেষ মহব্বতের সম্পর্কের কারিশমা এই যে, ওই সময় তার যবান মোবারক থেকে এমন কিছু কথা প্রকাশ পেল, যাকে প্রিয় মানুষকে দূরে যেতে দেখে, উদ্বেলিত দিলের আবেগাশ্রিত দর্পণের সাথে তুলনা করা যায়। তিনি বললেন-
يَا مُعَاذُ إِنَّكَ عَسَى أَنْ لاَ تَلْقَانِى بَعْدَ عَامِى هَذَا، أَوْ لَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِى هَذَا، أَوْ قَبْرِى هَذَا فَبَكَى مُعَاذٌ خَشَعًا لِفِرَاقِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم، ثُمَّ الْتَفَتَ فَأَقْبَلَ بِوَجْهِهِ نَحْوَ الْمَدِينَةِ، فَقَالَ: إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِى الْمُتَّقُونَ مَنْ كَانُوا وَحَيْثُ كَانُوا.
‘হে মুআয! আমার মনে হচ্ছে এ বছরের পর আমার সাথে তোমার আর সাক্ষাত ঘটবে না। এরপর হয়ত তুমি আমার কবর কিংবা মসজিদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে।’ সাহাবী মুআয রাদিআল্লাহু ‘আনহু এতক্ষণ পর্যন্ত অনেক কষ্টে নিজের আবেগ ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবান মোবারকে কথাটি শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। বেদনায় জারজার হলেন। তার ধারণা ছিল, এটা হয়ত এক-দেড় বছরের বিচ্ছেদ। কিন্তু সরকারে দো-আলম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কথাগুলো বললেন তখন তিনি বুঝলেন, জীবিত অবস্থায় আর কখনও এমন মধুর জলওয়া (মিলনদৃশ্য) সংঘটিত হবে না। তাই তার মুখ থেকে আহ্ শব্দ নির্গত হলো। চোখ ফেটে অশ্রু প্রবাহিত হওয়া শুরু করল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখে বললেন, মুআয! কেঁদো না। এবং এ কথা বলে হয়ত আবেগ দমনের জন্য তিনি নিজেও দ্রুত মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। মদীনার উদ্দেশে রোখ করার সময় বললেন- ‘মুত্তাকীরাই আমার সবচেয়ে আপনজন। চাই সে যেই হোক এবং যেখানেই হোক।’ [মুসনাদ আহমাদ : ২২০৫২, সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/৪৪৮]
অতএব, বহুদূরে থেকেও, বহু পরের মানুষ হয়েও আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় হতে পারি, স্নেহভাজন হতে পারি, ভালোবাসা লাভ করতে পারি। আপন হতে পারি। আল্লাহ- আল্লাহর রাসূলের আপন হতে নির্দিষ্ট দিন লাগে না, সময় লাগে না। বছরে একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতি নিয়ত, প্রতি মুহূর্ত ভালোবাসার সময়, প্রতিটি স্থানে ভালোবাসার সময়। যদি আমরা এই ভালোবাসা মনে জন্ম দিতে পারি, বুকে লালন করতে পারি তবে আর কাউকে ২৮০ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে না। কোনো মুসাকে খর্বাকায় একটা মেয়ে না পেয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন আসবে না। তখন আমার ঘর হবে ভালোবাসার মিনার, আমার হৃদয় হবে ভালোবাসার স্তম্ভচূড়া। এসো, হৃদয়ে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের ভালোবাসার মিনার গড়ি।
আপনি পড়ছেনঃ মুক্তবাসিনী ২ বই থেকে।
The post ভালোবাসা দিবসের পাপ appeared first on Amar Bangla Post.